ইতিহাস হল মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারাবাহিক বিবরণ। অতীতে ইতিহাসে শুধুমাত্র রাজা-মহারাজা কিংবা অভিজাতদের কথা লেখা থাকতো। বর্তমানে এই ধারায় পরিবর্তন এসেছে। এখন এখানে সাধারণ মানুষ, নিম্নবর্গীয় সমাজ, এমনকি প্রান্তিক অন্তজদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় জীবনের বিবর্তনের কথাও সমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। আধুনিক ইতিহাসচর্চার এই ধারা নতুন সামাজিক ইতিহাস নামে পরিচিত।
নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য : নতুন সামাজিক ইতিহাসের প্রধানত তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। এই ধারা তিনটি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১) মার্কসবাদী ধারা : উনিশ শতকে জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস বলেন, সামান্য সংখ্যক ধনী মানুষ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি - সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে। এই ধনীদের বিরুদ্ধে যুগে যুগে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র শ্রেণির মানুষ সংগ্রাম করে আসছে। এই সংগ্রাম আসলে শ্রেণি সংগ্রাম। অতীতে শোষিত দরিদ্র শ্রেণির এই জীবন সংগ্রামের কথা ইতিহাসে জায়গা পেতো না। নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চায় এদের কথা গুরুত্ব পায়। এই ধারার ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, জ্যঁ জরেস, টনি, হবসবম প্রমুখ। ভারতে এই ধারাকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন রজনীপাম দত্ত, রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব প্রমুখ ইতিহাসবিদ।
২) সামগ্রিক ইতিহাসচর্চা বা টোটাল হিস্ট্রি : এই ধারায় যান্ত্রিক মার্ক্সবাদ বর্জন করে মানুষের বিশ্বাস, রীতিনীতি, মানসিকতাসহ সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ওপর জোর দিয়েছেন। এঁদের মতে, ঐতিহাসিকের কাছে বিচার করা নয়, বোঝাটাই বেশি জরুরি। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০এর দশকে ফ্রান্সে এই ধারার সূচনা করেন মার্ক ব্লখ, লুসিয়েন ফেবর, ফার্নান্দ ব্রদেল, লাঁদুরি প্রমুখ ( অ্যানাল স্কুল গোষ্ঠী) ইতিহাসবিদ। এবং পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিকরা (পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট গোষ্ঠী) এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান।
৩) নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচর্চা (সাব-অল্টার্ন ) : এই ধারা অনুযায়ী জাতি, ধর্ম, বর্ন, লিঙ্গ, শ্রেণি নির্বিশেষে সমাজের নিম্নস্তরভুক্ত মানুষের জীবনধারাও ইতিহাসচর্চার অন্তর্ভুক্ত। শুধুমাত্র প্রতিবাদী আন্দোলন নয়, সমাজজীবনের বিভিন্ন পরিসরে আপাত তুচ্ছ ঘটনাও ইতিহাসের বিষয়বস্তু। ১৯৮০ র দশকে ভারতে এই ধারার সূচনা করেন রনজিৎ গুহ। এগিয়ে নিয়ে যান পার্থ চ্যাটার্জি, শাহিদ আমিন, সুমিত সরকার, গৌতম ভদ্র প্রমুখ।
এছাড়া মার্কিন ইতিহাসবিদ ইউজিন জেনোভিস, হারবার্ট গুটম্যান ইতিহাসচর্চায় উঠে এসেছে একটি বিশেষ ধারা। এখানে তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের নানাদিক, ক্রীতদাস ও দাস সমাজ ব্যবস্থার ওপর।
---------------------------------
এই বিষয়ের ওপর আরও প্রশ্ন দেখুন এখানে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন