রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন ও জীবনদর্শনের প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রকৃতি। তাঁর মতে, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় ত্রুটি হল, প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে শিক্ষার বিচ্ছিন্নতা। আর এজন্য আমাদের দেশের শিক্ষা শুধু অসম্পূর্ণই নয়, যান্ত্রিক এবং হৃদয়হীনও বটে।
শিক্ষা ও তার লক্ষ্য :
তাঁর মতে, শিক্ষা হলো বাইরের প্রকৃতি ও অন্ত:প্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন। এই সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে জাতির উপযোগী, দক্ষ ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলাই হলো শিক্ষার লক্ষ্য।
লক্ষ্য পূরণের উপায় :
তাঁর মতে, এই লক্ষ্য পূরণের জন্য একজন শিশুর প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে তার দেহ মন সুসংগঠিত করতে হয়। এটা করলেই সে পরমসত্তাকে উপলব্ধি করতে পারে।
লক্ষ্য পূরণের উদ্যোগ : শান্তিনিকেতনের ভাবনা :
১) শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা :
এই কারণেই তিনি প্রাচীন তপবনের শিক্ষার আদর্শ অনুপ্রাণিত হয়ে শান্তিনিকেতন স্থাপন করেছিলেন। এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রকৃতির স্নিগ্ধ ও সুশীতল পরিবেশে বসবাস করে শিক্ষা দান ও শিক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন করতে পারে।
২) হিতৈষী তহবিল তৈরি :
পল্লীগ্রামের মানুষের কল্যাণে এবং কৃষির উন্নতির জন্য গড়ে তোলেন হিতৈষী তহবিল। এই তহবিলের অর্থে চাষিদের বিপদকালে সহায়তা, বিদ্যালয় স্থাপন, রাস্তাঘাট তৈরির ব্যবস্থা করেন।
৩) কৃষি খামার তৈরি :
বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষাবাদ করার জন্য কৃষিবিদ্যা শিক্ষার ওপর জোর দেন এবং আধুনিক কৃষিখামার গড়ে তোলেন।
৪) কৃষি ব্যংক স্থাপন :
স্বল্প সুদে চাষিদের ঋণ দানের জন্য গড়ে তোলেন কৃষিব্যাংক এবং তাদের ফসলের উপযুক্ত দাম পাওয়া নিশ্চিত করতে নিজেই গড়ে তোলেন 'টেগোর এণ্ড কোং' নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
মানুষে মানুষে দ্বন্দ্বের কারণ :
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনে মানবপ্রেম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। মানুষের মধ্যে কোন কৃত্রিম ভেদাভেদ তিনি স্বীকার করেননি। তাঁর মতে, অজ্ঞতা থেকেই আসে ব্যবধান, পার্থক্য আর অহংকার। এই অহংকারের বসেই মানুষ নিজেকে অন্যদের থেকে পৃথক করে ফেলে। তৈরি হয় মানুষের মানুষের দ্বন্দ্ব।
প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় :
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, প্রকৃত শিক্ষা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষকে একাত্ম করে দেয়। ফলে মানুষ দ্বন্দ্ব ভুলে একাত্মতা প্রকাশ করে। এইভাবে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় ঘটে এবং মানুষের সার্বিক ও সঠিক জ্ঞান লাভ হয়।
দ্বন্দ্বের অবসান-এ প্রকৃতির ভূমিকা :
এই সার্বিক ও সঠিক জ্ঞান অজ্ঞানতা দূর করে স্বাধীন চিন্তা শক্তির বিকাশ ঘটায় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি জাগিয়ে তোলে। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, যে শিক্ষা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত ও সক্রিয় করে আমাদের মনকে অবুদ্ধির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে পারে সেই শিক্ষার দ্বারাই আমাদের সমস্ত দুঃখ দুর্গতির অবসান ঘটতে পারে।
এভাবে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের সমন্বয় গড়ে তুলে এক অভিনব মুক্ত শিক্ষাদর্শনের জন্ম দেন। শিক্ষাকে চার দেওয়ালের বাইরে এনে একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন যা বিশ্বজাতির মহামিলনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।
বিকল্প প্রশ্ন :
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা ভাবনা বিশ্লেষণ করো। এপ্রসঙ্গে তাঁর শান্তিনিকেতন-ভাবনার মূল্যায়ন করো। (প্রশ্নের মান - ৮)
ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত আরও কিছু প্রশ্ন উত্তর :
- ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিগুলি সংক্ষেপে লেখো।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনার সমালোচনামূলক আলোচনা করো। - ২০২৩
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তার কোন দিকটি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছিল?
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তার বৈশিষ্ট্য লেখো।
- মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করো।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন কেন?
খুব সুন্দর স্যার
উত্তরমুছুন