১৪৫৩ সালে তুর্কি শাসকদের হাতে কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটলে সেখানকার জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতবর্গ ইতালিতে চলে যান। তাঁদের উদ্যোগে পঞ্চদশ শতকে ইতালির বৌদ্ধিক জগতে যে বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটে তা 'ইউরোপীয় নবজাগরণ' নামে পরিচিত। উনবিংশ শতকের প্রথমদিকে বাংলাদেশে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটলে বাঙালির ভাবজগতেরও এরকম এক বৌদ্ধিক আন্দোলন শুরু হয়, যা ‘বাংলার নবজাগরণ’ নামে পরিচিত।
বিতর্ক বা মতপার্থক্য :
তবে এই বৌধিক আন্দোলন ও অগ্রগতিকে প্রকৃত অর্থে নবজাগরণ বলা যায় কিনা তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
নবজাগরণের পক্ষে যুক্তি :
ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, সুশোভন সরকার প্রমূখ একে নবজাগরণ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।
অন্যদিকে, অমলেশ ত্রিপাঠী একে নবজাগরণ বলে স্বীকার করলেও তার সঙ্গে ইতালির নবজাগরণের মূলগত পার্থক্য রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ইতালিতে স্বাধীন ও স্বনির্ভর বুর্জোয়া শ্রেণি নবজাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছিল। আর বাংলার নবজাগরণের নেতৃত্ব দিয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট বাংলার জমিদার শ্রেণী। অর্থাৎ এই নবজাগরণ মূলত জমিদার ও তাদের সহযোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
নবজাগরণের বিপক্ষে যুক্তি :
আবার অশোক মিত্র, বিনয় ঘোষ, সুপ্রকাশ রায়, ডক্টর বরুণ দে, ডক্টর সুমিত সরকার প্রমূখ বাংলার এই বৌদ্ধিক অগ্রগতিকে নবজাগরণ বলে স্বীকার করেন না।
অশোক মিত্র একে 'তথাকথিত নবজাগরণ' বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর যুক্তি হলো, এই জাগরণ ছিল শহরকেন্দ্রিক এবং এটি সীমাবদ্ধ ছিল পরজীবী ভূস্বামী শ্রেণীর মধ্যে।
বিনয় ঘোষ মনে করেন, উনিশ শতকের বাংলার জাগরণ ছিল একটি 'ঐতিহাসিক প্রবঞ্চনা'। সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, ‘বাংলার জাগরণ আন্দোলন ইউরোপীয় নবজাগরণ আন্দোলনের বিপরীত ধর্মী’।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলার এই নবজাগরণের ব্যাপ্তি ছিল খুবই সীমিত এবং তা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক বিশেষ করে কলকাতাকেন্দ্রিক। কেননা, গ্রাম বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এই নবজাগরণের কোন সুফল পায়নি। কলকাতা শহর কেন্দ্রিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রগতিশীল নাগরিক সমাজই মূলত এই আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
এছাড়া এই নবজাগরণ ছিল অতিমাত্রায় ব্রিটিশ নির্ভর। কারণ ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল মানুষজনই এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
কাল ক্রমে দেখা যায় বাংলার নবজাগরণ প্রকৃতপক্ষে হিন্দু জাগরণবাদে পর্যবসিত হয়। কারণ এই জাগরণের প্রধান দুটি ধারা ছিল যথাক্রমে প্রাচ্য পুনরুজ্জীবনবাদী ধারা এবং যুক্তিবাদী ধারা। এর পাশাপাশি একটি সমন্বয়বাদী ধারাও লক্ষ্য করা যায়, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রামমোহন রায় বি,দ্যাসাগর প্রমূখ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই তিন ধারারই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন।
একথা অনস্বীকার্য যে, এই নবজাগরণে বাংলার একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী তারা সচেতন ভাবেই এই আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে রেখেছিলেন।
মূল্যায়ন :
তবে, বাংলার নবজাগরণ মূলত কলকাতা শহরকেন্দ্রিক হলেও, ক্রমশ তা কলকাতা শহরজীবন অতিক্রম করে বাংলার সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিল এবং কিছুটা হলেও ভারতের অচলায়তন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ হয়েছিল। এখানেই তার সার্থকতা।
-------------------------------
বিকল্প প্রশ্ন :
- উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা কী ছিল?
- উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে কি প্রকৃত নবজাগরণ বলা যায়?
অন্যান্য প্রশ্ন :
- বাংলার নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো। (প্রশ্নের মান - ৮ )
এই বিষয়ে আরও প্রশ্ন ( প্রশ্নের মান - ৪ ) দেখতে এখানে ক্লিক করো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন