ভূমিকা : হুতোম প্যাঁচার নকশা। লেখক কালীপ্রসন্ন সিংহ। 'হুতুম পেঁচা' ছদ্মনামে এই গ্রন্থে তিনি তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কষাঘাতে কলকাতার বাবু সমাজের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, উৎসব অনুষ্ঠান, সামাজিক কুপ্রথা প্রচলিত ভাষায় ও হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন।
সমকালীন সমাজ- সংস্কৃতির চিত্র :
তাই এই গ্রন্থের মাধ্যমে উনিশ শতকে বাংলার সমাজ ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট ছবি আমরা পেতে পারি।
১) সামাজিক উৎসব :
গ্রন্থটি প্রথম ভাগে আলোচিত হয়েছে কলকাতার চড়ক পার্বন, বারোয়ারি পুজো, ছেলে ধরা, সাতপেয়ে ঘোড়া, লখনৌ এর বাদশা ইত্যাদি সামাজিক উৎসবের কথা।
গ্রন্থটির দ্বিতীয় ভাগে রথ দুর্গোৎসব রামলীলা প্রভৃতি উৎসবগুলির সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
২) সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস :
গ্রন্থটিতে কালীপ্রসন্ন সিংহ তৎকালীন সমাজের উচ্চ শ্রেণীভূক্ত ব্যক্তিদের তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন।
ক) প্রথম ভাগে রয়েছেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ যারা সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী।
খ) দ্বিতীয় ভাগে রয়েছেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কিন্তু সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণ নয় এমন ব্যক্তিরা।
গ) আর তৃতীয় ভাগে রয়েছেন ইংরেজি না জানা গোঁড়া হিন্দু সমাজ। এরা সবাই জাল জোচ্চুরি বা ফন্দি ফিকির করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে থাকেন।
৩) বাবু কালচার বা সংস্কৃতি :
এই সময় পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একশ্রেণীর মানুষ হঠাৎ আর্থিক দিক থেকে ফুলে ফেঁপে ওঠে। অর্থের অহংকারে তারা বিলাসী জীবন যাত্রা শুরু করে। গড়ে ওঠে বাবু কালচার। কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর গ্রন্থে এই বিলাসী মানুষজনদের সামাজিক অবক্ষয়ের দিকটি সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং এ বিষয়ে বাঙালির সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন।
৪) সামাজিক সংস্কার :
কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর 'হুতুম প্যাঁচার নকশা'য় বাংলার সমাজ জীবনে প্রচলিত সতীদাহ প্রথা বাল্যবিবাহ বহুবিবাহ ইত্যাদির বিরুদ্ধে যে সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল তারও সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছেন। রাজা রামমোহন রায় বিদ্যাসাগর প্রমুখের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।
৫) সমকালীন সাহিত্য ও শিক্ষা :
তাঁর এই গ্রন্থ থেকে একদিকে যেমন ইংরেজি শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে জানা যায় অন্যদিকে বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষার নানান প্রচেষ্টার কথাও জানা যায়।
সেইসঙ্গে জানা যায় বিদ্যাসাগরের 'সীতার বনবাস', টেকচাঁদ ঠাকুর এর 'আলালের ঘরের দুলাল' ইত্যাদির মত সাহিত্য সৃষ্টির কথাও
উপসংহার : বস্তুত, 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' গ্রন্থটি ঊনিশ শতকের কলকাতার এক বাস্তব ও বিশ্বস্ত দলিল। কালী প্রসন্ন সিংহ এখানে চলিত ভাষায় বাঙালির চারিত্রিক অধোগতিকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন