ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে লেখা ও রেখার ভূমিকা :
উনিশ শতকের ভারতীয়় জাতীয়তাবোধের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেছেছিল বিভিন্ন লেখক (লেখায়) ও চিত্রশিল্পী (রেখায়)। এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দমঠ', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গোঁরা', স্বামী বিবেকানন্দের 'বর্তমান ভারত' এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্র ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ভারতমাতা' চিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
ক) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের"আনন্দমঠ"এর অবদান
বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ প্রগাঢ় ও প্রভাব ফেলেছিল জাতীয়তাবাদীদের ওপর ।
1) আনন্দমঠ এর সন্তানদের উচ্চারিত বন্দেমাতরাম মন্ত্র দেশবাসীকেে মুক্তি আন্দোলনে আন্দোলিত করে।
2) এই গ্রন্থে দেশমাতৃকার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত মূর্তিগুলি তুলে ধরেন বঙ্কিমচন্দ্রবঙ্কিমচন্দ্রের "মা যাহা হইয়াছেন"- দশ জননীর এই মূর্তি হৃতসর্বস্ব নগ্নিকা দেশ এর মূর্তি। এই উক্তির মাধ্যমে।
3) এই মূর্তির মাধ্যমে শোষণ মুক্তা, কল্যাণী, জগদ্ধাত্রী দেশমাতৃকার মূর্তিকে তুলে ধরেছেন ।
4) আনন্দমঠ এর সন্তানদের আদর্শ ভারতের শিক্ষিত যুব সমাজকে বিশেষ করে কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের একাংশকে অনুপ্রাণিত করে।
5) সন্তানদের উদ্দেশ্যে সত্যানন্দ এর আহবাণ এর মধ্যে তিনি আসুরিক ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ধর্মান্ধতা জাগানোর ডাক শুনেছেন।
এছাড়াও অসুরবিনাশিনী দেবী দুর্গার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে উঠেছিল অরবিন্দের স্বপ্নের দেশ মাতৃকার মূর্তি।
আনন্দমঠ উপন্যাসটি সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রচারে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। এই গ্রন্থে তিনি একদল দেশপ্রেমিকের আত্ম উৎসর্গের কথা তুলে ধরেছেন। স্বদেশীকতা প্রসারে বন্দেমাতরম সংগীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সংগীতের দ্বারা বঙ্কিমচন্দ্র ভারত জননীর বাস্তব রূপ অংকন করেন এবং পরবর্তীকালে এই সংগীত ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামের উপর রূপ ধ্বনিতে পরিণত হয়। প্রত্যেকটি স্বদেশ প্রেমিকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় এই বন্দেমাতরম ধ্বনি ।
খ) স্বামী বিবেকানন্দের 'বর্তমান ভারতে'র অবদান
1) স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বর্তমান ভারত নামক গ্রন্থে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কে এক উচ্চ আধ্যাত্বিক আদর্শে উন্নীত করেন।
2) বিবেকানন্দের মতে স্বদেশ প্রেম ও মানবপ্রেমের সমন্বিত রূপ হলো জাতীয়তাবাদ।
3) উপনিষদের ঋষির মতো বেদান্তবাদী বিবেকানন্দ তার বর্তমান ভারত গ্রন্থে ভারতবাসীকে নতুন করে জেগে ওঠার আহ্বান জানান।
4) স্বামী বিবেকানন্দে বলেন- " ওঠো জাগো এবং নিজের প্রাপ্য বুঝে নাও"। তাঁর এই অভি: মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ভারতের যুব সমাজ তথা ভারতবাসী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
5) এই গ্রন্থ পাঠ করে ভারতবাসী উপলব্ধি করে যে দুর্বলতা ও ভীরুতা হল দাসত্বের নামান্তর। এই দুর্বলতাকে জয় করতে হবে।
6) বিবেকানন্দের প্রেরণা মৃত্যুকেও জয় করতে শিখিয়েছিল। এই গ্রন্থটি দুর্বলতা ভীরুতা হীনমন্যতা ও অনুকরণ এ মত্ত ভারতবাসীর মনোভূমিতে আত্মবিশ্বাস মূল্যবোধ ও স্বদেশপ্রেম জাগরিত করে ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত করে তোলে।
গ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গোঁরা' অবদান :
গোঁরা উপন্যাসটি হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অমর সৃষ্টি। সমকালীন জীবন চিত্র ও জাতীয়তাবোধ গভীর ভাবে ব্যাক্ত হয়েেছে এই উপন্যাসে। এই উপন্যাসে যে সকল দিক গুলি ফুটে উঠেছে তা হল নিন্মরূপ:-
1) এই উপন্যাসটির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ জাতিভেদের দ্বারা অস্পৃশ্যতা দ্বারা কলংকিত ভারতীয়় সমাজে সমন্বয়ের আদর্শ তুলে ধরে ভারতবাসীকে জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত করে তোলেন।
2) ভারতীয় সংস্কৃতির উদার ধর্মনিরপেক্ষতা, নিঃসঙ্গ ব্রাহ্মণ্য মহিমা, সার্বভৌম কারুণ্যয সর্বোপরি শান্ত-সত্য- নিষ্ঠা প্রভৃতি তুলে ধরেন।
3) সমাজজীবনের বৈষম্য আচার বিচারের প্রাধান্য, জাতিভেদের বিড়াম্বনা এবং জনসাধারণের অসহায় দরিদ্র ও অপরিসীম অজ্ঞতা যে দেশকে তিলে তিলে ধ্বংসের সিংহদ্বারে উপনীত করেছে রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসের মধ্যে তার সমাধানের পথনির্দেশ করেছেন।
4) এই উপন্যাসের মাধ্যমে দেশবাসীকে তিনি জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত করে তোলার চেষ্টা করেছেন।
ঘ) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও 'ভারতমাতা' চিত্রের অবদান :
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতা চিত্রের জীবিত রূপ হল আনন্দময়ী। গোরা উপন্যাসের শেষে পরিশিষ্ট অংশে সংস্কার শুন্য উদার আনন্দময়ীর মধ্যে গোড়া সেই ভারত মাতার প্রতি ছবি দেখেছেন- "তোমার জাত নেই,বিচার নেই, ঘৃণা নেই.. তুমি শুধু কল্যাণের প্রতিমা। তুমি আমার ভারত বর্ষ"। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই আনন্দময়ী কেই রূপ দিলেন বঙ্গমাতা রূপে এবং তা পরবর্তী তে ভারত মাতা হিসেবে ভারতীয় দের জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ভারত মাতা হয়ে ওঠে ভারতেরই প্রতিচ্ছবি।
উপরের সমস্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের জাতীয়তাবাদের বিকাশে লেখা ও রেখা দুটিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বিকল্প প্রশ্ন :
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন