মাধ্যমিক ইতিহাস সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর - ২০২২
দুটি বা তিনটি বাক্যে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর দাও:
৩.১) সামরিক ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব কী?
সামরিক ইতিহাসে শুধুমাত্র যুদ্ধের কারণ ও ফলাফলের মধ্যে যুদ্ধ বিষয়ক আলোচনা সীমাবন্ধ নেই —১) যুদ্ধের খুটিনাটি বিষয়ও যে যুদ্ধকে প্রভাবিত ও ফলাফলকে নিয়ন্ত্রণ করে তা সামরিক ইতিহাসে আলোচিত হয়েছে।
২) সামরিক ইতিহাস থেকে কোন রাষ্ট্র বা জাতি বা সংগঠনের যুদ্ধাস্ত্র, রণকৌশল, সামরিক পোশাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতির বিবর্তন সহ বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত যুদ্ধের কারণ, পদ্ধতি, সমরসজ্জা, যুশ্বের আদর্শগত দিক প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়, যেগুলি যুদ্ধকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে।
তাই আধুনিক সামাজিক ইতিহাসে সামরিক ইতিহাস চর্চা গুরুত্বপূর্ণ।
৩২) 'সরকারি নথিপত্র' বলতে কী বোঝায়?
'সরকারি নথিপত্র' বলতে বোঝায় পুলিশসহ সরকারি আধিকারিকদের গোপন ও প্রকাশ্য লেখা চিঠিপিত্র, প্রতিবেদন, বিবরণ, সমীক্ষা, নোটিশ প্রভৃতি। এই সব নথিপত্র থেকে সরকারি মনোভাব, পদক্ষেপ, উদ্যোগ প্রভৃতি জানার পাশাপাশি ঐ নির্দিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, হান্টার কমিশনের রিপোর্ট থেকে শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়, নীল কমিশনের রিপোর্ট থেকে কৃষক বিদ্রোহের কথা জানতে পারা যায়।মনে রাখা দরকার, সরকারি নথিপত্রগুলি সরকারের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী থেকে লেখা হয় বলে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী উপেক্ষিত থাকে এবং অনেকক্ষেত্রে বিকৃত তথ্যের উপস্থাপনা সমকালীন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
৩.৩) স্কুল বুক সোসাইটি কেন প্রতিষ্ঠিত হয়?
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিক থেকে সরকারি ও বেসরকারি উদ্দ্যোগে বাংলা তথা ভারতে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হলে সর্বস্তরে পাঠ্যপুস্তকের অভাব লক্ষ্য করা যায়।ইংরাজি ও বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা, মুদ্রণ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের উদ্দেশ্যে ১৮১৭ খ্রিঃ ডেভিড হেয়ার কলকাতায় স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
৩.৪) মধুসুদন গুপ্ত স্মরনীয় কেন?
কলকাতা সংস্কৃত কলেজের ছাত্র মধুসূদন গুপ্ত সামাজিক কুসংস্কার ও জাতিচ্যুত হওয়ার ভয় না পেয়ে —১) ১৮৩৬ খ্রিঃ ১০ই জানুয়ারি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ (মৃতদেহ কাটা / অ্যানাটমি শিক্ষা) করেন যা ছিল রক্ষণশীল গোষ্ঠীর বিপ্রতীপে যুগান্তরকারী ঘটনা।
২) তাছাড়া তিনি 'লন্ডন ফার্মাকোপিয়া' ও 'অ্যানাটমি' গ্রন্থ দুটি বাংলায় অনুবাদ করে ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা চর্চাকে সহজসাধ্য করে তোলেন।
৩.৫) লর্ড হার্ডিও-এর 'শিক্ষাবিষয়ক নির্দেশ নামা' গুরুত্বপূর্ণ কেন?
১৮৪৪ খ্রিঃ লর্ড হার্ডিঞ্জ এক নির্দেশনামার মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ইংরাজি ভাষা জানা ব্যক্তিদের অগ্রাধিকারের নীতি ঘোষণা করলে —১) ভারতীয় মধ্যবিত্তশ্রেণি ইংরাজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল।
২) এই প্রবল আগ্রহ ইংরাজি স্কুল স্থাপনে বাঙালি তথা ভারতীয়দের উদ্যোগ বাড়িয়েছিল।
৩) অন্যদিকে দেশীয় ভাষা ও শিক্ষা পদ্ধতির গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছিল।
৩.৬) 'বাংলার নবজাগরণ' বলতে কী বোঝায়?
উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলা তথা ভারতের মধ্যযুগীয় কুসংস্কার ও সংকীর্ণ মানসিকতার পরিবর্তে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ প্রভৃতি ধ্যান-ধারণা প্রসার ঘটে। এর ওপর ভিত্তি করে বাংলায় ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি সকলক্ষেত্রে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। ইউরোপের রেনেসাঁর সাথে তুলনা করে, বেশীরভাগ ঐতিহাসিক এই আন্দোলনকে 'বাংলার নবজাগরণ' আখ্যা দিয়েছেন।৩.৭) ফরাজি আন্দোলন ব্যর্থ হল কেন?
ফরাজি আন্দোলন বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়েছিল-১) দুদুমিওজ্ঞা (মহম্মাদ মহসীন)-এর মৃত্যুর পর নোয়া মিঞা ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচীর পরিবর্তে অতিরিত্ব পরিমানে ধর্মের উপর গুরুত্ব আরোপ করায় এই আন্দোলন মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবন্ধ হয়ে পড়লে আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
২) দুদুমিঞার পরবর্তীকালে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা, ফরজি আন্দোলনকে ব্যর্থতার পর্যবসিত করেছিল।
৩) ফরাজিবা পুরানো অস্ত্রশস্থ যেমন- লাঠি, বল্লম, দাঁ, কুড়ুল বা কুঠার প্রভৃতি নিয়ে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ ও অন্যান্য শাসকশ্রেণি (জমিদার, মহাজন)-এর বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ে পরাজয় স্বীকার করেছিল।
৩.৮) তিতুমীর স্মরনীয় কেন?
বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা তিতুমীর (মীর নিশার আলি) ইসলাম ধর্মের সংস্কারের পাশাপাশি১) ইংরেজ সরকার, জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
২) এবং এই উদ্দেশ্যো উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার নারকেলবেড়িয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা তৈরী করে একটি স্বাধীন দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
৩) সেখানে তিতুমীর নিজেকে 'বাদশা', মৈনুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী ও গোলাম মাসুমকে সেনাপতি ঘোষণা করে স্বল্পকালীন স্বাধীন সরকার চালিয়েছিলেন।
শেষপর্যন্ত ইংরেজদের কামানের আঘাতে তাঁর বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয় এবং তিনি নিহত হন। মূলত এ কারণেই তিনি ইতিহাসের স্মরণীয় হয়ে আছেন।
৩.৯) শিক্ষিত বাঙালি সমাজের একটি অংশ কেন মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) বিরোধিতা করেছিল?
শিক্ষিত বাঙালি সমাজের একটি অংশের মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭ খ্রিঃ) বিরোধিতা করার পিছনে যুক্তি ছিল—১) শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশ মনে করেছিল যে, বিদ্রোহিরা সফল হলে ভারতে মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ইংরেজরা যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছিল তা ব্যহত হবে।
২) শিক্ষিত বাঙালি সমাজের একটি অংশ ইংরেজ সরকারের অধীনে কর্মরত ছিল। বিদ্রোহিরা সফল হলে তাদের কাজ হারাবার আশঙ্কায় তারা মহাবিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল।
৩) উনিশ শতকের বাংলা তথা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চার প্রসার ব্যহত হতে পারে, এই আশঙ্কায় শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল।
৩.১০) ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হয় কেন?
সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদের পরিবর্তে উপহাসমূলক ও বিদ্রূপাত্মক সমালোচনার জন্য ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হয়।যে কোন বিষয় ও ঘটনাকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজ সরল ও আনন্দদায়ক করতে ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করা হয়। অসাধারণ ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁর বিভিন্ন চিত্রে উপনিবেশিক সমাজ ব্যবস্থার ছবি তুলে ধরা হয়েছে। গিরিন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অমৃতবাজার পত্রিকায় মিউনিসিপ্যাল আইনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম বাংলা ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করেন।
৩.১১) নবগোপাল মিত্র কে ছিলেন?
ইংরেজ সরকার ও খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তরিতকরণ ও হিন্দুধর্মের বিরোধিতার ফলে হিন্দুরা যখন নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে হীনমন্যতায় ভুগছিলেন সেই সময় হিন্দুদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা, জাতীয়তাবাদ ও স্বদেশ প্রেমের বিস্তার ঘটাতে নবগোপাল মিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।হিন্দুকেন্দ্রিক ভারতে পুনর্জাগরণের উদ্দেশ্যে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে 'হিন্দুমেলা' প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি জাতীয় প্রতীকগুলির মর্যাদা দান, দেশীয় ভাষার চর্চা, হিন্দু ধর্মের অতীত গৌরবগাঁথার প্রচার, শরীর চর্চার মাধ্যমে আত্মশক্তি জাগরণে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
এছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যাশনাল প্রেস, ন্যাশনাল পেপার, ন্যাশানাল সোসাইটি, ন্যাশানাল স্কুল, ন্যাশনাল থিয়েটার, ন্যাশনাল জিমনাসিয়ম এবং ন্যাশানাল সার্কাস ইত্যাদি। এই প্রভূত কর্মকান্ডের জন্য তাঁর ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল 'ন্যাশনাল মিত্র'।
৩.১২) উনিশ শতকের বাংলায় জাতীয়তাবাদের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের কীরূপ ভূমিকা ছিল।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'আনন্দমঠ' উপন্যাস, 'বলাদর্শন' পত্রিকা প্রভৃতি প্রকাশের মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের ভারতীয়দের ওপর অকথ্য অত্যাচারের নগ্নরূপ তুলে ধরার পাশাপাশি ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সুমহান দিকগুলিরও সূক্ষাতিসুক্ষভাবে বিশ্লেষণ করেন। তিনি 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের মাধ্যমে জন্মভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করে 'বন্দেমাতরম' সঙ্গীতের ব্যবহার করেন যা পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্রে পরিণত হয়ে ওঠে।৩.১৩) জাতীয় শিক্ষা পরিষদ কেন প্রতিষ্ঠিত হয়?
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯০৬ খ্রিঃ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল-১) ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিকল্পরূপে জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীকে আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা।
২) মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলার পাশাপাশি তাদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা ও জাতীয়তাবোধের প্রসার ঘটানো।
৩.১৪) 'বিদ্যাসাগর সার্ট' বলতে কী বোঝায়?
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা মুদ্রণে অক্ষর বিন্যাসের সমস্যা দূরীকরণে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে ছেদ, যাতি চিহ্নের ব্যবহার সহ বাংলা বর্ণ বিন্যাস ও সাজানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর নামানুসারে এর নাম হয় 'বিদ্যাসাগর সাট'।৩.১৫) বাংলা ছাপাখানার বিকাশে লাইনোটাইপ প্রবর্তনের গুরুত্ব কী?
সারিবদ্ধভাবে লেখা ছাপানোর পদ্ধতিকে ‘লাইনোটাইপ’ বলা হয়। লাইনোটাইপ-এর বিশেষত্ব হল —১) এতে বিভিন্ন ধরনের কি-বোর্ড রয়েছে। অক্ষর, যুক্তাক্ষর, বিরামচিহ্ন ও স্পেস একসঙ্গে ছাপানো যায়।
২) এই প্রক্রিয়ায় খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, বই প্রভৃতি দ্রুত এবং সহজে ছাপানো সম্ভব হয়।
লাইনোটাইপের আবিষ্কার ছাপাখানার ইতিহাসে বিপ্লব ঘটায়, এর সৃষ্টিকর্তা হলেন সুরেশচন্দ্র মজুমদার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন