সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

১৯৬৬ সালের ছয়-দফা আন্দোলনের পটভূমি ও গুরুত্ব

১৯৬৬ সালের ছয়-দফা আন্দোলনের পটভূমি ও গুরুত্ব সম্পর্কে লেখো

Write the background and importance of the six-point movement of 1966,ছয়-দফা আন্দোলনের পটভূমি ও গুরুত্ব
১৯৬৬ সালের ছয়-দফা আন্দোলনের পটভূমি ও গুরুত্ব

১৯৬৬ সালের ছয়-দফা আন্দোলনের পটভূমি ও গুরুত্ব

ছয় দফা কর্মসূচি :

তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অর্থনৈতিক শোষণ, জাতিগত নিপীড়ন ও প্রশাসনিক বঞ্চনা পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে ক্রমান্বয়ে অসন্তুষ্ট করে তুলেছিল। এই পরিস্থিতে পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যে কর্মসূচি ঘোষণা করেন তা ছয় দফা কর্মসূচি বা ছয় দফা দাবি নামে পরিচিত।

ছয়-দফা আন্দোলনের পটভূমি :

১. সামাজিক প্রেক্ষাপট :

দেশ এক হলেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান ছিল বিস্তর। ফলে জন্ম নেয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বাঙালির মুক্তি লাভের ব্যাপারে অনুপ্রেরণা যোগায়।

২. রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট :

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হয় এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি গোষ্ঠী যুক্তফ্রন্টকে কৌশলে ক্ষমতা ক্ষমতাচ্যুত করে এবং সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে তাদের শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। 

৩. অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট :

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দেখা যায় দেশের বৈদেশিক আয়ের ৭০ শতাংশ আসত পূর্ব পাকিস্তান থেকে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজকোষে জমা হতো মাত্র ২৫ শতাংশ। বাকি অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য খরচ করা হতো। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য বাঙালি জাতিকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

৪. ধর্মীয় প্রেক্ষাপট :

পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তৃতীয় শ্রেণির মুসলমান, ভারতের দালাল, নিম্ন শ্রেণির হিন্দুদের জাত ইত্যাদি বলে তাদের প্রতি চরম অবহেলা দেখাতো। এরূপ ধর্মীয় অবজ্ঞা ছয়দফার প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

৫. জাতীয়তাবোধ তৈরি :

 পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাঙালিজনগোষ্ঠীকে শাসন ও শোষণ করছে  - এই বেদনা বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। এ সম্পর্কে 'বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি' প্রবন্ধে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, "বাঙালি জাতীয়তাবাদের চালিকা শক্তি হিসেবে ৬ দফা চূড়ান্ত জিম্মাদারে পরিণত হয়"।

৬. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি :

পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রই সকল শাসনতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতো! তাই কেন্দ্র হতে পৃথক হয়ে স্বাধিকার বা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরালো হতে থাকে।

 এই পটভূমিতেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন। বাঙালিদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ ও শোষণ ছয়দফার অন্যতম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

ছয়দফা আন্দোলনের গুরুত্ব :

ছয়দফা আন্দোলনের তাৎপর্য বা গুরুত্ব হলো :

১. প্রথম লিখিত প্রতিবাদ :

পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক যে শাসক ও শাসিত নীতির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান এই ছয় দফা দাবির মাধ্যমে তা স্পষ্ট করেন তোলেন। দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য সম্বন্ধে সরকার ও জনগণকে এই প্রথম লিখিত রূপে জানানো হয়। 

২. বাঙালি স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ :

ছয়দফা হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে নিয়ে গঠিত বাঙালি স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভরশীলতার চাবিকাঠি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

৩. পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণ : 

ছয়দফা দাবির মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমা শাসকচক্রের ঘাঁটিতে আঘাত হানে। আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেন।

৪. সরকারের দমননীতি :

শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা দাবি পেশ করার পর আইয়ুব সরকার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ মে "প্রতিবাদ দিবস" পালিত হয় এবং ৭ জুন হরতালের ডাক দেওয়া হয়। সরকার হরতাল বন্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করলে ১০ জন নিহত হন।

৫. আগরতলা মামলা :

পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের দমন করার জন্য আগরতলা মামলা শুরু করে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এবং সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে। তবে আন্দলনের চাপে এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়।

৬. স্বায়ত্তশাসনের পথ প্রশস্ত :

ছয়দফা দাবির প্রথম দফা দাবি ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন যা লিখিতভাবে পেশ করা হয়। এই প্রস্তাবা শেষ পর্যন্ত বাঙালির জন্য আলাদা আবাসভূমির প্রস্তাবে পরিণত হয়। 

৭. বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ :

ছয়দফা ছিল মূলত বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ছয় দফার মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে শাসকবর্গ যে বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্টি করেন তার প্রতিবাদ জানানো হয়। 

৯. আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত :

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের ১৭ দিনব্যাপী যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এতে শেখ মুজিবুর রহমান ধারণা করে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা সেনাবাহিনী বা সামরিকবাহিনী দরকার। ১৯৬৬ সালের ছয়দফার শেষ দফা দাবি ছিল আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন করতে হবে। 

১০. ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান :

১৯৬৬ সালের ছয়দফার প্রস্তাবকে সামনে রেখে আইয়ুব খান শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করেন। আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলে পূর্ব বাংলায় জনরোষ সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়।

১১. আইয়ুব সরকারের পতন :

১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবির প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা তীব্র গণআন্দোলন অচিরেই গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। পরিণতিতে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ রাতে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।

১২. বাংলাদেশের বীজ নিহিত :

১৯৭১ সালে যে মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাঙালিরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন, তার বীজ ছয় দফার দাবির মাধ্যমে রোপণ করা হয়েছিল। রওনক জাহান বলেছেন, ৬ দফা বাঙালিদের স্বাধীনতার দলিলপত্র। 

১৩. আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা :

 ১৯৬৬ সালের ছয়দফা এদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। 

উপসংহার :

আসলে ১৯৬৬ সালের ছয়দফা ছিল বাঙালির জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ ছয়দফা দাবির মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, আঞ্চলিক সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়। ১৯৬৬ এর ছয়দফা দাবির উপর ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থান, নির্বাচন, সবশেষে মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়। একারণেই অনেকের মতে, আজকের যে স্বাধীন বাংলাদেশ তার ভিত্তি ছিল এই ছয় দফা দাবি। এটাই ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ।
----------xx---------

মন্তব্যসমূহ

বহুল পঠিত প্রশ্ন-উত্তর এখানে

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো

অথবা           টীকা লেখা:- সাঁওতাল বিদ্রোহ  উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে সমস্ত উপজাতি বিদ্রোহ হয়েছিল ।তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাঁওতাল বিদ্রোহ। ব্রিটিশ সরকারের উপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার জন্য,  ব্রিটিশ সরকার যে সমস্ত ভূমি সংস্করণ করেছিল তার  প্রভাব ভারতীয় উপজাতিদের মধ্যে ব্যাপক ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।  তাই শেষ পর্যন্ত 1855 খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয় । যা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।    সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ বিহারের রাজমহল থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিস্তীর্ণ  অঞ্চলের  শান্তিপ্রিয় সাঁওতালরা বিভিন্ন কারণে ব্রিটিশদের উপর রেগে গিয়েছিল। যা হলো নিম্নরুপ:-  ক) জমির উপর ব্রিটিশদের অধিকার :- সাঁওতালরা জঙ্গল পরিষ্কার করে  জমি তৈরি করে  চাষবাস শুরু করলে । ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালদের কাছে  এমন বিপুল হারে রাজস্বের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। যা সাঁওতালরা জমি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।    খ) সাঁওতালদের সর্বস্বান্ত :- ব্রিটিশ সরকার  ভূমিরাজস্ব ছাড়াও অন্যান্য কর ও ঋণের দায়ভার সাঁওতালদের উপ...

কে, কবে, কেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন?

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার কারণ  লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ সালে কলকাতায় ‘ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ’  প্রতিষ্ঠা করেন। কারণ, তারা মনে করতেন, ১) ভারতীয়রা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা পেলে ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে  স্বাধীনতার স্পৃহা জেগে উঠবে  এবং এদেশে কোম্পানির শাসন সংকটের মধ্যে পড়বে। ২) এছাড়া ভারতীয়দের  ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করলে  তারা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে। ৩) এই আশঙ্কা থেকেই মূলত তারা  আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিবর্তে সংস্কৃত ও আরবি-ফারসি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব  আরোপ করেন এবং  ধর্মভিত্তিক সনাতন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ইংরেজ রাজকর্মচারীদের ভারতীয়দের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষিত করে  এদেশে কোম্পানির শাসনকে সুদৃঢ় করার পরিকল্পনা করেন। মূলত, এই কারণেই লর্ড ওয়েলেসলি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গড়ে তোলেন।

খুৎকাঠি প্রথা কী?

খুঁৎকাঠি বা কুন্তকট্টি হল এক ধরনের ভূমি ব্যবস্থা যা মুন্ডা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এই ব্যবস্থায় জমিতে ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে যৌথ মালিকানা স্বীকৃত ছিল। ব্রিটিশ সরকার এই ব্যবস্থা বাতিল করে ব্যক্তি মালিকানা চালু করলে মুন্ডাদের জমি গুলি বহিরাগত জমিদার, ঠিকাদার ও মহাজনদের হাতে চলে যায়। ফলে মুন্ডারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অবশেষে ১৯০৮ সালে ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের এই প্রথা (ভূমি ব্যবস্থা) ফিরিয়ে আনে। অন্যান্য প্রশ্ন : ভারতীয় অরণ্য আইন কী? ব্রিটিশ সরকার কেন অরণ্য আইন পাশ করেছিল? বারাসাত বিদ্রোহ কী? বাঁশেরকেল্লা কী? খুৎকাঠি প্রথা কী? দাদন প্রথা কী? সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় কেন? ওয়াহাবি আন্দোলনের লক্ষ্য আদর্শ কী ছিল? ফরাজি আন্দোলন কি ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আন্দোলন? তিতুমীর স্মরণীয় কেন? দুদুমিয়া স্মরণীয় কেন? দামিন-ই-কোহ কী? মুন্ডা বিদ্রোহের লক্ষ্য কী ছিল?  নীল বিদ্রোহে হরিশচন্দ্র মুখার্জীর ভূমিকাকী ছিল? নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারীদের ভূমিকা কী ছিল? 'দার-উল-হারব' এবং 'দার-উল- ইসলাম' কথার অর্থ কী? নীলকররা নীল চাষীদের উপর...

নতুন সামাজিক ইতিহাস কী?

ইতিহাস হল মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারাবাহিক বিবরণ । অতীতে ইতিহাসে শুধুমাত্র রাজা-মহারাজা কিংবা অভিজাতদের কথা লেখা থাকতো। বর্তমানে এই ধারায় পরিবর্তন এসেছে। এখন এখানে সাধারণ মানুষ, নিম্নবর্গীয় সমাজ, এমনকি প্রান্তিক অন্তজদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় জীবনের বিবর্তনের কথা ও সমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। আধুনিক ইতিহাসচর্চার এই ধারা  নতুন সামাজিক ইতিহাস  নামে পরিচিত।

নীল বিদ্রোহের কারণ কী? এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব লেখ।

নীল বিদ্রোহ : কারণ, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব : আঠারো শতকে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব হয়। ফলে সেখানে বস্ত্র শিল্পের প্রয়োজনে নীলের চাহিদা বাড়ে। ১৮৩৩ সালে সনদ আইন এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লুপ্ত হলে কোম্পানির কর্মচারিরা ব্যক্তিগতভাবে নীল চাষে নেমে পড়ে। অধিক মুনাফার আশায় এইসব কর্মচারীরা নীল চাষীদের উপর সীমাহীন শোষণ ও অত্যাচার শুরু করে। এই শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীল চাষিরা হাজার ১৮৫৯ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ নীল বিদ্রোহ নামে খ্যাত।  নীল বিদ্রোহের কারণ  (পটভূমি ) : নীল বিদ্রোহের পিছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ লক্ষ্য করা যায়। ১) কৃষকের ক্ষতি: নীল চাষের চাষের যে খরচ হতো মিল বিক্রি করে চাষির সে খরচ উঠতো না। ফলে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ২) খাদ্যশস্যের অভাব:  নীল চাষ করতে গিয়ে কৃষকেরা খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রয়োজন মতো করতে পারত না। কারণ নীলকর সাহেবরা চাষীদের নীল চাষে বাধ্য করতেন। ফলে চাষির ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ৩) নীলকরদের অত্যাচার :  চাষিরা নীল চাষ করতে অস্বীকার করলে নীলকর সাহেবরা তাদের উপর নির্মম অত্যাচার।...

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি আলোচনা করো:

১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি: ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে. এক পক্ষের ঐতিহাসিকরা বলেন, এটি ছিল নিছক সিপাহী বিদ্রোহ। অপরপক্ষ বলেন, এটি ছিল জাতীয় আন্দোলন। তা ছাড়াও কেউ কেউ আবার এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, সামন্ততান্ত্রিক প্রতিবাদ, কৃষক বিদ্রোহ, মুসলিম চক্রান্ত প্রভৃতি নানা নাম অভিহিত করেছেন। ১) সিপাহী বিদ্রোহ:   ইংরেজ ঐতিহাসিক চার্লস রেক্স, হোমস, এবং ভারতীয়দের মধ্যে কিশোরীচাঁদ মিত্র, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে নিছক সিপাহী বিদ্রোহ বলেছেন। তাঁদের বক্তব্য - ক)১৮৫৭ সালের বিদ্রোফের চালিকাশক্তি ছিলেন সিপাহীরাই। তাদের অসন্তোষ থেকেই বিফ্রহের সূচনা হয়েছিল। খ) এই বিদ্রোহে ভারতীয় জাতীয় চেতনার অগ্রদূত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী যোগদান করেনি বা ভারতের সমস্ত অঞ্চলের রাজারা আন্দোলনকে সমর্থন করেনি। ২) জাতীয় আন্দোলন: ঐতিহাসিক নর্টন, জন কে, কার্ল মার্কস প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে , ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আন্দোলনে যোগদান করেছিল; বিদ্রোহ...

মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করো।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন ও জীবনদর্শনের প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রকৃতি। তাঁর মতে, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় ত্রুটি হল, প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে শিক্ষার বিচ্ছিন্নতা। আর এজন্য আমাদের দেশের শিক্ষা শুধু অসম্পূর্ণই নয়, যান্ত্রিক এবং হৃদয়হীনও বটে। শিক্ষা ও তার লক্ষ্য : তাঁর মতে, শিক্ষা হলো বাইরের প্রকৃতি ও অন্ত:প্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন। এই সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে জাতির উপযোগী, দক্ষ ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলাই হলো শিক্ষার লক্ষ্য। লক্ষ্য পূরণের উপায় : তাঁর মতে, এই লক্ষ্য পূরণের জন্য একজন শিশুর প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে তার দেহ মন সুসংগঠিত করতে হয়। এটা করলেই সে পরমসত্তাকে উপলব্ধি করতে পারে। লক্ষ্য পূরণের উদ্যোগ : শান্তিনিকেতনের ভাবনা : ১) শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা : এই কারণেই তিনি প্রাচীন তপবনের শিক্ষার আদর্শ অনুপ্রাণিত হয়ে শান্তিনিকেতন স্থাপন করেছিলেন। এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রকৃতির স্নিগ্ধ ও সুশীতল পরিবেশে বসবাস করে শিক্ষা দান ও শিক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন করতে পারে। ২) হিতৈষী তহবিল তৈরি : পল্লীগ্রামের মানুষের কল্যাণে এবং কৃষির উন্নতির জন্য গড়ে তোলেন হিতৈষী তহবি...

শিক্ষার চুঁইয়ে পড়া নীতি' বলতে কী বোঝ?

'শিক্ষার চুঁইয়ে পড়া নীতি' বলতে কী বোঝ? লর্ড বেন্টিং-এর আইন সচিব টমাস ব্যাবিংটন মেকলে  ১৮৩৫  সালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব দেন যা  'মেকলে মিনিটস'  নামে পরিচিত। এই প্রস্তাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের স্বপক্ষে যুক্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটবে এবং তাদের দ্বারা তা চুইয়ে ক্রমশ সাধারণ দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে ভারতীয়রা রুচি, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় ইংরেজদের মত হয়ে উঠবে। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে মেকলের নেওয়া এই নীতি   ' চুঁইয়ে পড়া নীতি'   নামে পরিচিত। 

তিন আইন কী?

 তিন আইন কী ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হল ' তিন আইন'   পাস হওয়া।  ১৮৬৬ সালে কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহ বিষয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকার উৎসাহিত হয় এবং  ১৮৭২  সালে একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের ফলে  বাল্যবিবাহ  ও  বহুবিবাহ  প্রথা নিষিদ্ধ এবং   অসবর্ণ বিবাহ  বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। বিবাহ সংক্রান্ত এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে তৈরি এই আইন ইতিহাসে ' তিন আইন'  নামে পরিচিত। 

ইলবার্ট বিল কি?

লর্ড রিপন ভারতে আসার আগে কোন ভারতীয় বিচারকরা কোন অভিযুক্ত ইংরেজের বিচার করতে পারত না। এই বৈষম্য দূর করতে লর্ড রিপনের পরামর্শে তার আইন সচিব ইলবার্ট একটি বিলের খসড়া রচনা করেন। এই  খসড়া বিলে ভারতীয় বিচারকদের ইংরেজ অভিযুক্তের বিচার করার অধিকার দেওয়া হয়। এই খসড়া বিলই ইলবার্ট বিল (১৮৮৩) নামে পরিচিত। এই বিলের পক্ষে এবং বিপক্ষে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, ইলবার্ট বিল আন্দোলন ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিকল্প প্রশ্ন : কতসালে ইলবার্ট বিল পাস হয়? এর উদ্দেশ্য কী ছিল? অন্যান্য প্রশ্ন : বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন । প্রশ্নের মান - ৪ (সাত-আট বাক্যে উত্তর)   ইলবার্ট বিল কী? এই বিলের পক্ষে বিপক্ষে কী প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল? ইলবার্ট বিল আন্দোলনের গুরুত্ব লেখো। ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন । প্রশ্নের মান - ৮ (পনের-ষোলো বাক্যে উত্তর) ইলবার্ট বিল আন্দোলন বলতে কী বোঝ? এই আন্দোলনের তাৎপর্য কী ছিল?