শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ ব্যাখ্যা করো।
![]() |
শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ |
উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তাঁর ধর্মীয় আদর্শের মূল কথা ছিল ‘সর্বধর্ম সমন্বয় সাধন’।
ধর্ম-দর্শনের প্রেক্ষাপট :
উনিশ শতকে হিন্দু ধর্ম যখন একদিকে খ্রিস্ট ধর্ম ও ব্রাহ্ম ধর্মের সাঁড়াশি আক্রমণ এবং অন্যদিকে জাতপাত ও আচার সর্বস্বতায় জর্জরিত, ঠিক তখনই সহজিয়া আধ্যাত্মিকতা এবং সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শকে তুলে ধরেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ছিলেন দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিনী কালী মন্দিরের পুরোহিত। তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও পাশ্চাত্য আদব-কায়দা বর্জিত একজন নিত্যান্ত গ্রাম্য সাধক হয়েও তিনি ভারতীয় সনাতন ধর্ম-দর্শন ও সংস্কৃতির নির্যাসকে উপলব্ধি করেছিলেন একজন আলোকিত মানুষের মতই।
রামকৃষ্ণের ধর্ম-দর্শনের মূল কথা :
শ্রীরামকৃষ্ণের সহজ সরল জীবনযাপন পদ্ধতি, গল্পচ্ছলে ধর্মের গুরুবাণী বুঝিয়ে দেওয়া, অসীম ঈশ্বরে বিশ্বাস, লোভ ও মোহ ত্যাগ করে জীবন যাপনের চর্চা, তাঁকে এক বিশিষ্ট আসনে আসীন করেছে। তাঁর দর্শনের মূল কথা হল :
- ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন : বৈষ্ণব, শাক্ত, তন্ত্রসাধন মার্গের সঙ্গে একাধারে ইসলাম, খৃষ্ট, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ধর্মদর্শন অনুসন্ধানের পর তিনি উপলব্ধি করেন, ‘ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন’। রাম ও রহিম আসলে একই সত্তা।
- যত মত তত পথ : দীর্ঘ সাধনার পর তিনি উপলব্ধি করেন, সব ধর্ম সত্য এবং সব ধর্মমত অনুসরণেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। তাই তিনি বলেন, ‘যত মত তত পথ’।
- নব্য বেদান্ত : শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্তের নতুন ব্যাখ্যা দেন। তাঁর দেওয়া ব্যাখ্যা ‘নব্য বেদান্ত’ নামে পরিচিত। তিনি বলেন, পরমাত্মা বা ঈশ্বর এবং জীবাত্মা বা মানুষ উভয়েই আসলে অভিন্ন।
- যত্র জীব তত্র শিব : নব্য বেদান্তের এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী মানুষ অনন্ত শক্তির আধার। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের বসবাস। তাই ‘মানুষের সেবাই ঈশ্বরের সেবা’।
- নিষ্কাম কর্ম ও ঈশ্বর লাভ : রামকৃষ্ণ বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর লাভের জন্য কর্মত্যাগের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নিষ্কাম কর্মের। সত্য, সহিষ্ণুতা এবং সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও আত্মনিবেদনের দ্বারাই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
- নারী জগন্মাতার প্রতিমূর্তি : নারী তাঁর কাছে জগন্মাতার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। তাই তিনি নারী জাতির দুর্দশা মুক্তির লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা নেন।
মন্তব্য :
রামকৃষ্ণের সহজ সরল ও লৌকিক আধ্যাত্ম্যবাদ এবং ‘সর্বধর্ম সমন্বয়ী ভাবনা’ হিন্দুধর্মকে গ্রামের চালাঘর থেকে জমিদারের দালান এবং কলকাতার চাকরিজীবী বাবুদের বৈঠাখানাকেও সমাদৃত করে তোলে। ফলে, হিন্দুধর্ম নবচেতনায় বলিয়ান হয়ে ওঠে। রামকৃষ্ণের বিমূর্ত সর্বধর্ম-সমন্বয় ও মানবতাবাদকে মূর্ত করে তুলেছিলেন তাঁর ভাব-শিষ্য বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
-----------xx-----------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন